কালপেঁচার ডাক || হিমাদ্রিকিশাের দাশগুপ্ত (পর্ব ১)
By Arman Ali
প্রায়
এক ঘণ্টা সময় স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠান মঞ্চে নানা
ধরনের শব্দ, পশুপাখির ডাক নকল করে শােনানাের
পর চিন্ময়বাবু শেষ যে ডাকটা ডাকলেন, তা গ্রামাঞ্চলে
অতি পরিচিত প্রাণী শিয়ালের ডাক। এবং তাঁর এই 'হুক্কাহুয়া’
ডাক এত নিখুঁত হল যে তাঁর এই ডাকের পরমুহূর্তেই স্কুলবাড়ির
পিছনের জঙ্গল থেকে দিনের আলাে থাকা সত্ত্বেও সত্যিকারের
শিয়ালের দল প্রত্যুত্তর দিল, ‘হুয়া, হুয়া’! হাততালির ঝড় উঠল
মঞ্চর সামনে। একজন গ্রামবাসী চিন্ময়বাবুর শব্দর খেলায় খুশি হয়ে
একটা একশাে টাকার নােট নিয়ে সেটা তুলে ধরল তাঁকে দেওয়ার
জন্য। তা দেখে লােকটির উদ্দেশে চিন্ময় বললেন, না না, টাকা
দেবেন না। এই হরবােলার খেলা আমার পেশা নয়, নেশা।
আমি
একটা সরকারি চাকরি করি। ওই যে আপনাদের বিডিও সাহেব
পরিতােষবাবু রয়েছেন, তিনি আমার বন্ধু, তাঁর আমন্ত্রণেই আমি
এখানে এসেছি। আমার হরবােলা কণ্ঠস্বরের খেলা যে আপনাদের
ভালাে লেগেছে, সেটাই আমার পুরস্কার।
এ কথাগুলি বলে মঞ্চ থেকে নেমে পড়লেন চিন্ময়বাবু।
পরিতােষবাবুর সঙ্গে তাঁর বাসস্থানে যাবেন। কাছেই।
আজ সকালের
ট্রেনে কলকাতা থেকে বর্ধমানের এই গ্রামে এসে সেখানেই উঠেছেন
তিনি। রাতেও সেখানে তিনি থাকবেন। দুই বাল্যবন্ধু মিলে সারারাত
গল্প হবে। তারপর আগামিকাল সকালের ট্রেনে চিন্ময়বাবুর
কলকাতা ফেরার কথা।
চিন্ময়বাবু স্টেজ থেকে নামতেই তাকে ঘিরে ধরল একদল ছােট
ছেলে। তাদের বিস্ময়ের সীমা নেই হরবােলা শুনে। একটা উৎসাহী
ছেলে শিশুসুলভ ভাবে চিন্ময়বাবুর উদ্দেশে বলল, আমি একটা
পাখির ডাক জানি। কাকের ডাক।' এই বলে সে কা কা করে
ডেকে উঠল। অন্য ছেলেরাও কা কা করে ডাকতে লাগল।
যদিও
চিন্ময়বাবু বেশ মজা পেলেন ব্যাপারটায়, কিন্তু তিনি বিব্রত হচ্ছেন
ভেবে হেড মাস্টারমশাই ছুটে এলেন। আর তা দেখে ছাত্রদের দল
সরে গেল। পরিতােষবাবু কাছেই অতিথি আসনে বসেছিলেন।
তিনিও এবার উঠে দাঁড়ালেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই স্কুল কর্তৃপক্ষ
কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তাঁরা দু’জন স্কুলের মাঠ পেরিয়ে রওনা
হলেন রাস্তার দিকে। সেখানে পরিতােষের সরকারি গাড়িটা দাঁড়িয়ে
আছে। বিকাল পাঁচটা বাজে। শীতের দিন। আর কিছু সময়ের মধ্যেই
সূর্য ডুবে ধীরে ধীরে অন্ধকার নামতে শুরু করবে। হাঁটতে হাটতে
পরিতােষ তার বাল্যবন্ধুকে বললেন, ‘দারুণ অনুষ্ঠান করলি তুই।
ভাগ্যিস ছেলেবেলার অভ্যাসটা ধরে রেখেছিলি। সবাই খুব তারিফ
করলেন। আচ্ছা, সেইবার কলকাতায় তাের বাড়িতে গিয়ে বেশ
কয়েকটি পেঁচার মূর্তি দেখেছিলাম। তুই কালপেঁচার ডাক জানিস?
শুনেছিস কখনও? এখানে পাওয়া যায়। ও ডাক গ্রামের লােকরা
খুব ভয় পায়।'
চিন্ময় বললেন, 'না, কালপেঁচার নাম শুনেছি বটে। ওর একটা
মূর্তিও আমার সংগ্রহ করার ইচ্ছা আছে। কিন্তু সত্যিকারের
কালপেঁচা আমি চোখে দেখিনি বা তার ডাকও শুনিনি।
চিন্ময়বাবুর কথার জবাবে পরিতােষবাবু কিছু একটা বলতে
যাচ্ছিলেন, কিন্তু পরিতােষবাবুর মােবাইল বেজে ওঠাতে এ
আলােচনা থেমে গেল। ফোনকলটা রিসিভ করে কয়েকটি কথা
বলে নিয়ে পরিতােষ আক্ষেপের স্বরে চিন্ময়বাবুর উদ্দেশে বলেন,
‘এ চাকরি আমার আর ভালাে লাগছে না। জীবনে কোনও স্বাধীনতা
নেই। ডিএম সাহেব ফোন করে সদরে ডেকে পাঠালেন। আমাকে
এখনই একবার বর্ধমান শহরে যেতে হবে। ফিরতে ফিরতে হয়তাে
রাত বারােটা বেজে যাবে। আমাকে ক্ষমা কর ভাই। ভেবেছিলাম
সন্ধ্যা থেকে গল্প করতে বসব। তা আর হল না!
চিন্ময়বাবু বন্ধুর কথা শুনে আপসেট হলেও একজন সরকারি
কর্মী হিসেবে তিনি জানেন যে পরিতােষদের প্রশাসনিক চাকরিটা
এমনই, যখন তখন ওপরমহল থেকে ডাক আসে। তাই তিনি
বন্ধুর উদ্দেশে বললেন, 'না, না, ক্ষমার কথা কেন বলছিস! এমন
তাে হতেই পারে। তুই শুধু আমাকে সাজেশন দে সন্ধ্যাটা কীভাবে
কাটানাে যেতে পারে?
পরিতােষ একটু ভেবে নিয়ে সামনের রাস্তার একদিক দেখিয়ে
চিন্ময়বাবুকে বললেন, “আজ তাে পূর্ণিমা। এই রাস্তার শেষ মাথায়
প্রতি পূর্ণিমাতে একটা মেলা বা হাট বসে। গ্রামীণ মেলা। দুপুর থেকে শুরু হয়ে রাত আটটা পর্যন্ত চলে। রিকশায় যেতে পনেরাে
মিনিট মতাে লাগে। তুই ঘুরে আসতে পারিস। মন্দ লাগবে না। আর
মেলাতে যেতে না চাইলে আমার বাড়ি ফিরে টেলিভিশন দেখতে
পারিস কিংবা বই পড়তে পারিস। কেয়ারটেকার তাে বাড়িতেই
আছে, কোনও অসুবিধা হবে না।'
পরিতােষের কথা শুনে চিন্ময় বললেন, ‘আমি তবে মেলাটা ঘুরে
নিয়ে তাের বাড়ি ফিরছি।
পরিতােষ বললেন, হ্যাঁ, মেলাটাই দেখে আয়। এ জায়গার
পরিবেশ খুব শান্ত। রাতেও বিপদের আশঙ্কা নেই। আমি যথাসম্ভব
দ্রুত ফিরে আসার চেষ্টা করছি।
কথা বলতে বলতেই পরিতােষের গাড়ির কাছে পৌঁছে গেলেন
তাঁরা। চিন্ময়বাবুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পরিতােষ নিজের গাড়ি
নিয়ে রওনা হয়ে গেলেন জেলা সদরের দিকে।
পরিতােষ চলে যাওয়ার মিনিট তিনেকের মধ্যে চিন্ময়বাবু একটা
পথ চলতি রিকশা পেয়ে তাতে চড়ে বসলেন। সূর্য ঢলার সঙ্গে
সঙ্গেই ঠান্ডা নামতে শুরু করেছে। নিজের গায়ের চাদরটা ভালাে
করে জড়িয়ে নিলেন তিনি। রিকশা তাঁকে নিয়ে চলল মেলার মাঠের
দিকে। স্কুলবাড়িকে পিছনে ফেলে একটু এগতেই রাস্তা বেশ ফাঁকা
হয়ে গেল। আশ পাশ দেখতে দেখতে চললেন তিনি। যাত্রা পথের
দুপাশে বড় বড় গাছ, আর সামান্য কিছু ঘরবাড়ি
তাদের ফাঁক গলে দিগন্তবিস্তৃত মাঠ দেখা যাচ্ছে। ফসল কেটে
নেওয়ার পর জন্যশুন্য মাঠ। কিছুটা পথ এগনাের পর যাত্রাপথের
একপাশে পুরনােদিনের বেশ বড় একটা বাড়ি চোখে পড়ল
চিন্ময়বাবুর। বাড়িটার চারপাশে বড় বড় গাছের জঙ্গল।
তাদের
ডালপালার ফাঁক দিয়ে আসা দিনশেষের সূর্যালােকে বাড়িটিকে
কেমন যেন বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। সারাদিন এখানে ওখানে খাবারের
সন্ধানে ঘরে ফিরে আসার পর বড় একটা কাকের জটলা
গাছ গুলাের মাথায়। গাছগুলাের মাথাতেই সম্ভবত ওদের বাস।
চিন্ময়বাবু বাড়িটা দেখে কৌতূহলী হয়ে রিকশচালক ছেলেটির কাছে
জানতে চাইলেন, ‘এটা কার বাড়ি?
ছেলেটা জবাব দিল, ‘তা জানি না বাবু। তবে লােকে এ
বাড়িটাকে ‘পেঁচাবাড়ি' বলে ডাকে। ওই দেখুন বাড়িটার মাথায়
একটা পেঁচা বসানাে আছে।'
চিন্ময়বাবু ছেলেটার কথা শুনে তাকিয়ে দেখলেন, সত্যিই
বাড়িটার মাথার উপরের কার্নিশে একটা বেশ বড় পেঁচা বসানাে
আছে। এ ব্যাপারটা অবশ্য আশ্চর্যর কিছু নয়। পেঁচা হল মা
লক্ষ্মীর বাহন। বর্ধমান ধানের জেলা। ধান-মা লক্ষ্মীপেঁচা
এর
সব একসূত্রে গাঁথা। ফসল বা সমৃদ্ধি কামনাতে কেউ লক্ষ্মীদেবীর
বাহনকে স্থান দিতেই পারেন নিজের বাড়ির মাথায়। রিকশা
তারপর আগের মতােই চলতে লাগল। কিছু সময়ের মধ্যেই রাস্তায়
লােকজনের সংখ্যা বাড়তে লাগল, চিন্ময়বাবুর কানে আসতে
লাগল মেলার হইহট্টগােলের শব্দ।
রিকশা থেকে চিন্ময়বাবু যখন মেলার মাঠে নামলেন, ঠিক
তখনই সম্ভবত সূর্য ডুবল। একসঙ্গে অনেকগুলাে জেনারেটর
শব্দ করে চলতে শুরু করল আর সঙ্গে সঙ্গে চট অথবা প্লাস্টিকের
ত্রিপল দিয়ে তৈরি মেলার অস্থায়ী দোকানগুলিতে আলাে জ্বলে
উঠতে লাগল। বিশাল একটা মাঠ, তার মধ্যে বড় বড় গাছও আছে।
আর তার মধ্যেই মেলাটা বসেছে। স্থানীয় মানুষরা এই মেলাকে
ডাকেন পূর্ণিমার হাট’ নামে। এ কথাটা মাইকে মেলার ঘােষকের
কথায় জানতে পারলেন চিন্ময়বাবু। ভরা সন্ধ্যায় জমজমাট পূর্ণিমার
হাটে প্রবেশ করলেন তিনি। ব্যস্ত দোকান চারপাশে। মাটির হাঁড়ি
কড়াই থেকে শুরু করে সস্তার নিত্যপ্রয়ােজনীয় জিনিসের দোকান
জামাকাপড় থেকে শাকসবজি, ধানের বস্তা, এমনকী ছাগল-হসিমুরগিও বিক্রি হচ্ছে মেলাতে। আর আছে অগুনতি খাবারের
দোকান। গরম জিলিপি, শিঙাড়া বিক্রি হচ্ছে সেসব দোকানে। এক
ঠোঙা জিলিপি কিনে খেতে খেতে দোকানগুলিতে ঘুরে বেড়াতে
লাগলেন তিনি। সময় এগিয়ে চলল। অন্ধকার নামল মাঠের বাইরে।
বিরাট মাঠে অনেকক্ষণ ধরে ঘুরে বেড়ালেও তার কেনার মতো
তেমন কিছু পেলেন না তিনি। মাঠের মধ্যে এক জায়গায় মজার
খেলা দেখাচ্ছে। বাঁশের মাথায় দডির ওপর দিয়ে হাঁটা, ছোট
ভােজবাজির খেলা। সেসব দেখতে লাগলেন চিন্ময়বাবু।
ঘণ্টাখানেক সে খেলা দেখলেন তিনি। খেলা দেখা যখন শেষ হল
তখন চিন্ময়বাবু খেয়াল করলেন, ভিড় যেন এবার পাতলা হতে
শুরু করেছে। রিস্টওয়াচের দিকে তাকিয়ে চিন্ময়বাবু বেশ অবাকই
হলেন। মেলায় ঘুরতে ঘুরতে আর মাদারির খেলা দেখতে দেখতে
কখন যেন ঘন্টা দু-আড়াই সময় কেটে গিয়েছে। অবশ্য চিন্ময়বাবুর
ফেরার তাড়া তেমন কিছু নেই। পরিতােষ তাে রাত বারােটার আগে
ফিরবে না। চিন্ময়বাবু যদি পায়ে হেঁটেও ফেরেন তবে এ জায়গা
থেকে পরিতােষবাবুর বাড়ি পৌঁছতে তাঁর আধ ঘন্টা লাগবে।
তবে
মেলা ভাঙার আগে বাকি দোকানগুলাে একবার দেখে নেওয়ার
জন্য হাঁটতে লাগলেন তিনি। একসময় তিনি মেলার শেষ প্রান্তে
পৌঁছে গেলেন। এ জায়গাতে ভিড় বেশি নেই। তার ওপর আবার
মেলা তখন ভাঙতে শুরু করেছে। এক জায়গায় একটা লোক
খাঁচাতে সাদা ইঁদুর, খরগােশ, গিনিপিগ এসব বিক্রি করছে।
সে
দোকানটা দেখার পর ফেরার জন্য পা বাড়াতে গিয়েও কিছুটা
তফাতে একটা বড় গাছের নীচে মাটিতে বসা দোকানের দিকে
হঠাৎই তাঁর চোখ আটকে গেল। সার সার কাঠের পেঁচা সাজানাে
রয়েছে একটা প্লাস্টিকের ওপর। তবে দোকানদার তার পসরা
এবার গােটাতে শুরু করেছে। পেঁচাগুলােকে একটা একটা করে সে
ব্যাগে ভরতে শুরু করেছে। লােকে যেমন গণেশ মূর্তি সংগ্রহ করে
তেমনই পেঁচার মূর্তি সংগ্রহ করার শখ আছে চিন্ময়বাবুর। তাই তিনি
এগিয়ে গিয়ে গাছের নীচে দোকানটার সামনে দাঁড়ালেন।
একটা
বড় কুপি জ্বলছে। তার আলােয় সাজানাে আছে কাঠের তৈরি রং
করা পেঁচার মূর্তি। এই কাঠের পেঁচা এই বর্ধমান জেলারই নতুন
গ্রাম' নামের এক গ্রামে তৈরি হয়। সারা দেশে প্রসিদ্ধ এই কাঠের
পেঁচা। অনেকেই এই পেঁচা দিয়ে ঘর সাজায়। চিন্ময়বাবুর নিজের
সংগ্ৰহতেও এমন একটা পেঁচা আছে। সেটা অবশ্য কলকাতা
থেকেই কেনা। তিনি পসরার দিকে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলেন।
নতুন ধরনের কোনও পেঁচা আছে কি না! না তেমন কিছু চোখে
পড়ল না তাঁর। দোকানি পেঁচাগুলাে ব্যাগে ভরতে ভরতে বলল,
‘আপনি পেঁচা নেবেন? ভাঙা হাটে শেষবেলায় অর্ধেক দামে দেব।'
দোকানদারের কথার সময়ই হঠাৎই চিন্ময়বাবুর পরিতােষের
বলা কালপেঁচার কথা মনে পড়ে গেল। তিনি লােকটাকে বললেন,
“তােমাদের এখানে নাকি কালপেঁচা’ পাওয়া যায় ?
কালপেঁচার
মুর্তি আছে তােমার কাছে?
প্রশ্নটা শুনে কয়েক মুহূর্তের জন্য যেন থমকে গেল লােকটা।
তারপর গম্ভীর ভাবে জবাব দিল ‘কালপেঁচা খুব অশুভ। ও পেঁচা
দেখলে লােকে মারা যায়। ডাক শুনলেও ক্ষতি হয়। কালপেঁচার
মূর্তি কেউ বানায় না।
লােকটা হয়তাে এরপর ভাবল, এই বাবু মশকরা করছে তার
সঙ্গে। পেঁচা কেনার খদ্দের বাবু নন। তাই যে এরপর চটপট
পেঁচাগুলাে ব্যাগে ভরে কুপি নিভিয়ে তার মালপত্র নিয়ে উঠে
পড়ল। মেলার মাঠ এবার প্রায় ফাঁকা হয়ে গিয়েছে, একে একে
আলােগুলাে নিভতে শুরু করেছে। চিন্ময়বাবুও এবার ফেরার জন্য
পা বাড়াতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু একটা কণ্ঠস্বর কানে গেল তাঁর
‘আপনি কালপেঁচা দেখেছেন কখনও? তার ডাক শুনেছেন?'
চিন্ময়বাবু পিছনে তাকি দেখলেন একজন লােক এসে
দাঁড়িয়েছেন তাঁর পিছনে। গাছের নীচে আবছা আলােতে যতটুকু
বােঝা যাচ্ছে তাতে লােকটাকে যুবকই মনে হয়। পরনে প্যান্ট
শার্টের ওপর সােয়েটার। মাথায়-কানে মাফলার জড়ানাে। হাতে
একটা বড় চটের ব্যাগ। নিশ্চয়ই লােকটা দোকানদারের সঙ্গে
চিন্ময়বাবুর কথােপকথন শুনেছেন, তাই এই প্রশ্ন।
চিন্ময়বাবুর প্রশ্নর জবাবে বললেন, 'না, কালপেঁচার কথা শুনলেও তা
চোখে দেখিনি বা তার ডাক শুনিনি। আসলে আমি পেঁচার মূর্তি
সংগ্রহ করি, তাই দোকানদারের কাছে জিজ্ঞেস করছিলাম। কথাটা
শুনে লােকটা বললেন, আমি কিন্তু আপনাকে কাল পেঁচা
দেখাতে পারি, ডাক শােনাতে পারি। আপনি যে পথে ফিরবেন সেই পথেই।
চিন্ময়বাবু মৃদু বিস্মিত ভাবে বললেন, 'আমি কোন পথে ফিরব
আপনি জানলেন কীভাবে?
লােকটা যেন মৃদু হাসলেন। তারপর জবাব দিলেন, 'আপনি
আজ স্কুলে হরবােলার খেলা দেখিয়েছেন তো? বি ডি ও সাহেবের
বাড়িতে এসে উঠেছেন। সেখানেই নিশ্চই ফিরবেন? এখান থেকে
একটাই তাে পথ। আসলে গ্রামে বাইরে থেকে মানুষ এলে তার
সম্বন্ধে কিছুক্ষণের মধ্যেই সারা গ্রাম জেনে যায়।
লােকটার কথার জবাবে চিন্ময় হেসে বললেন, 'হ্যাঁ, আমি সেই
লােক। এখন সেখানেই ফিরব।
লােকটা বললেন, ‘চলুন তবে এগই আমরা। যেতে যেতে কথা
হবে। আমার বাসস্থানও ওই পথেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই মেলার
মাঠের বাইরে এসে উপস্থিত হলেন তাঁরা। মেলা ভেঙে গিয়েছে।
বাইরেটাও বেশ ফাঁকা ফাঁকা হয়ে এসেছে। লােকটা চিন্ময়বাবুকে
বললেন, ‘সামান্য তাে রাস্তা। দেখেছেন তাে কী সুন্দর চাঁদের
আলাে ফুটেছে! হেঁটে যেতে নিশ্চই আপনার অসুবিধা হবে না?
বেশ গল্প করতে করতে যাওয়া যাবে।'
সত্যিই মাথার ওপরের ফটফটে চাঁদের আলাে ছড়িয়ে পড়েছে
চারপাশে। সম্ভবত একেই বলে কাক জ্যোৎস্না’। পথ চলতে
কোনও অসুবিধা হবে না চিন্ময়বাবুর। তাছাড়া হয়তাে কালপেঁচা
দেখানাের জন্য তাঁকে পায়ে হেঁটেই নিয়ে যেতে চাইছেন লােকটা।
চিন্ময়বাবু বললেন, ‘চলুন, আমার হেঁটে যেতে আপত্তি নেই। কিন্তু
আপনার নামটা আমার এখনও জানা হয়নি।
লােকটা জবাব দিলেন, আমার নাম সুবল সূত্রধর। আমি কিন্তু
আসলে শহরের মানুষ। সরকারি আর্ট কলেজ থেকে পাশ করা।
একজন শিল্পী। এখন এখানেই থাকি। আমি যে বাড়িতে থাকি
সেখানে অনেক পেঁচার মূর্তি আছে। বাড়ির ল্যান্ডলেডির এক সময়
আপনার মতাে নানা ধরনের পেঁচার মূর্তি সংগ্রহের বাতিক ছিল।
আমার নিজের তৈরি একটা কালপেঁচার মূর্তিও আছে সেখানে।
সুবল সূত্রধরের কথা শুনে বেশ উৎসাহিত বােধ করে তার সঙ্গে
ফেরার পথ ধরলেন চিন্ময়বাবু।
Some posts by this author
Delete
Confirm To Delete
All Comments of
Login to add comment0